বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য প্রবন্ধ রচনা

বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য প্রবন্ধ রচনা 


                "ঋতুর দল নাচিয়া চলে 
                  ভরিয়া ডালি ফুলে ও ফলে"
                                           রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ভূমিকা:-

নানা বৈচিত্র্য ও রঙে পূর্ণ বঙ্গ প্রকৃতির ঋতুর রঙ্গশালা। বঙ্গ জননীর দুয়ারে ছটি ঋতু তার রঙ, রূপ ও আনন্দের ডালি নিয়ে পালাক্রমে হাজির হয়। প্রতিটি ঋতুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে অপরূপ। ঋতুতে ঋতুতে চলে সাজ বদল। যেন ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি ; / নব নব পাত্র ভরি ঢালি দেয় তার রূপসী বাংলার নিসর্গ জগতে আড়ম্বরের অভাব নেই বরং অস্তিত্বের গভীরে নিহিত রয়েছে অভিনব আয়োজন।


ঋতুর ক্রম

জলবায়ুর বিবর্তনে ছয়টি ঋতু বাংলায় আবির্ভূত হলেও এদের স্থায়িত্বকাল আগের মতো সমান নয়। তারপরও ছয়টি ঋতুতেই প্রকৃতি নতুন রুপে সাজে। সে সাজ কখনো রুদ্র, রুক্ষ, কখনো সবুজ-শ্যামল কখনো বা ফুলে-ফলে শোভিত। ঋতু গুলোর বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য-সম্ভার আলাদা হলেও এক অদৃশ্য গতির শৃঙ্খলে সবাই বাঁধা। ঋতুগুলো যেন অদৃশ্য কোনো শিল্পীর সুদক্ষ পরিচালনায় আবির্ভূত হয়ে এদেশের মানুষের হৃদয়ে আবেগ, আনন্দ-উল্লাস জাগিয়ে তোলে।
                
বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য প্রবন্ধ রচনা

তপ্ত দগ্ধ গ্রীষ্মকাল

'প্রখর তপন তাপে হৃদয় তৃষায় কাঁপে ' ... ঋতুচক্রের শুরুতেই ধুলাই ধূসর রুক্ষ, পিঙ্গল জটাজাল নিয়ে আবির্ভাব ঘটে গ্রীষ্মের। ধরণি যেন বৈরাগীর উত্তরীয়ের রং গ্রহণ করে। নববর্ষের পূন্যবাসরে তার শুভারম্ভ, জ্যৈষ্ঠের শেষ অবধি এর ব্যাপ্তি। দারুন অগ্নিবাণে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তুলতেই যেন তার আবির্ভাব। কালবৈশাখীর দুরন্ত ঝাপটায় পুরনো জীর্ণজরাকে ঝরিয়ে দেওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে আসে। প্রচন্ড গরমে জীবকূল যখন বৃষ্টি বিন্দুর জন্য ছটফট করতে থাকে, তখন কালবৈশাখীর মত্ত ঝাপটার সঙ্গে বৃষ্টিও আসে। মাটির সোঁদা গন্ধে আমরা বিশ্বকবিকে স্মরণ করি। তবে গ্রীষ্ম শুধু উত্তাপই দেয় না। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে বকুল, চামেলি, মল্লিকা প্রভৃতি সুগন্ধি ফুলের ডালি সাজায়। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজের মতো সুস্বাদু ফলের সুমিষ্টি গন্ধ এ সময়ের বাতাসকে যেমন মদির করে রাখে তেমনি আমাদের মন প্রাণ ভরিয়ে দেয়।



বর্ষার উন্মাদনা

                 "গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি
                   গরজে গগনে গগনে"

আষাঢ় শ্রাবণ মাস নিয়ে বর্ষা আসে দিগ্বিজয়ী বীরের মতো কালো মেঘের পিঠে সওয়ার হয়ে, ভোজ্যের ডামাডোল বাজিয়ে, বিদ্যুতের নিশান উড়িয়ে। বর্ষার এই সাড়ম্বর আগমনে প্রকৃতির সর্বত্র বিপুল সাড়া জাগে। মত্ত দাদুরীর উচ্চস্বর, ডাহুক এর উন্মাদনা, পাখিদের কলতানে প্রকৃতি উচ্ছল। অন্যদিকে কেতকী, কদম্ব, বকুল, বেল জুঁই, হাঁসগুহানার সুমধুর গন্ধে বাংলার প্রকৃতি হয় আমোদিত।

অরণ্যের প্রান্তরে জেগে ওঠে আনন্দের হিল্লোল জল তোল থৈ থৈ মাঝে " আমরা চাষ করি আনন্দে / মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধ্যে"। বর্ষার বদৌলতে আমাদের শ্রেষ্ঠ ফসল ধান, পাট প্রভৃতি সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে যেমন হাজির হয়, তেমনি খামখেয়ালি বর্ষা, কোথাও অতিবর্ষণে বন্যা এনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে নানা ভাবে বিঘ্নিত করে।


লাবণ্যের শরৎ

"আজকে তোমার মধুর মূরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে; / হে মাত বঙ্গ ! শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অমল শোভাতে"।                                                           রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ভাদ্র আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎ আসে নীল আকাশে সাদা পাল তুলে। শরতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে মাঠ-ঘাট, নদ-নদী ঝলমল করতে থাকে। নদী তীরে ফোটে কাশফুল, সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে, শিশির ভেজা শিউলি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে হাসে ঘাসের বুকে। রাতের আকাশের রসে লাখো তারার মেলা। শরতের রূপে প্রকৃতি হয় পরিপূর্ণ। তাইতো শরৎ রূপের রানী। রবি ঠাকুরের কথায় - " আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা রে ভাই, লুকোচুরির খেলা "। শিউলি বিছানো পথেই আসেন মা ও মা, এই শরতেই মা উমার পরেই আসেন মা লক্ষ্মী, মা কালী, উদযাপিত হয় ভাতৃদ্বিতীয়।



হিমেলী হেমন্ত 


              "সবুজ পাতার খামের ভেতর
                হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
                কোন্ পাথারের ওপার থেকে
                আনল ডেকে হেমন্তকে?"
                                            সুফিয়া কামাল

শরতের তিরোভাবের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে কুয়াশার ঘোমটা টেনে বিষাদখিন্ন হাজির হয় হেমন্ত। সে নীরব। বাংলার এই ঋতুর আবির্ভাব এবং স্থায়িত্ব অনেকটাই অনুভূতি নির্ভর। 

সাঁঝ সকালে নদীর কূলে ডেকে আনে কুয়াশাকে। মটরশুঁটি, খেসারি আর কলাই ফুলে হেমন্তের ডালি সেজে ওঠে। হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায় শরীর জাগিয়ে তুলে শিহরণ। 
আপামোর বাঙালি তখন মিষ্টি রোদে খেজুরের রসের সাথে মিষ্টি পিঠের স্বাদ আস্বাদনে মশগুল থাকে।

এ সময়ে ফসলের মাঠে পূর্ণতা দেখা যায়। উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব। প্রকৃতি ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। অবশেষে প্রকৃতিকে ঘাসের উপর হীরের মতন চিকচিকে শিশির উপহার দিয়ে হেমন্ত বিদায় নেয়।


শীতের রিক্ততা


"হিম হিম শীত শীত / শীত বুড়ি এলো রে;/ কন কনে ঠান্ডায় দম বুঝি গেল রে"।

শির শয্যায় হেমন্তের অবসানে আসে শীত।
শীত ঋতু যেন হেমন্তেরই প্রগাঢ়তর রূপ। শীত পূর্ণতার ঋতু। উত্তুরে সমীরণে গাছপালার পাতা ঝরতে শুরু করে। চারিদিকে রুক্ষভাব দেখা যায়। তাহলেও অঢেল খাদ্যশস্য ও টাটকা শাকসবজি শীতের উপহার। পৌষ পার্বণের পিঠাপুলি, মাঘের খেজুরের রস, বনভোজনের আয়োজন, জীবনের আনন্দকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।




বসন্তের সঞ্জীবনী

ঋতুচক্রের শেষ ঋতু বসন্ত আসে ফাল্গুন চৈত্র মাস নিয়ে, শীতকে বিদায় দিয়ে। 

বসন্ত ঋতুরাজ, এ ঋতু আসে নবীন প্রাণ, নবীন উৎসাহ, উদ্দীপনা ও যৌবনের সঞ্জীবনী সুধা নিয়ে। তার পরশে কচি কিশলয় কিংশুক রঙে রঙিন হয়ে ডালে ডালে চোখ মেলে। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয় আকাশ বাতাস। কোকিলের কু কু ধ্বনিতে মানুষের মনে জাগে, আনন্দের স্পন্দন।

ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখর হয় ফুলবাগান। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় নানান রঙের প্রজাপতি। অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, মধুমালতীর গন্ধে প্রকৃতির রাজ্যে শুধু হয় মাতামাতি। বসন্ত উৎসব, দোলের উৎসব, চড়ক, শিবরাত্রি, বাসন্তী পূজায় ঋতু হয় আরো মধুমাখা। ঋতুরাজ বসন্তের রূপে মুগ্ধ কবি তাই হয়ে উঠেন - 

"আহা, আজি এ বসন্তে তো ফুল ফোটে, / এত বাঁশি, এতো পাখি গায়"।

                                           রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উপসংহার

কতোনা সৌন্দর্য ও বর্ণময়তা নিয়েই বঙ্গ প্রকৃতিতে ছয় ঋতুর উপস্থিতি। প্রত্যেকেরই নিজস্বতা তার রঙে রূপে ও মনমোহিনী আয়োজনে। ঋতুর সঙ্গে জীবনের নিবিড় যোগ এবং বাঙালির সামাজিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। রূপসী বাংলা তার ও কৃপণ হাতে উজাড় করে দেয় আনন্দের সুধা রস।
কিন্তু শিল্প বিপ্লবের আগ্রাসন, বিশ্ব উষ্ণায়নের হানাহানি, ঋতু সৌন্দর্যকে অনেকখানি ম্লান করে দিয়েছে। 

শেষ কথা 

আশাকরি আপনাদের সকলের বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য প্রবন্ধ রচনাটি খুব ভালো লেগেছে।



Post a Comment

0 Comments